সাধারণভাবে স্থানীয় সরকার হলো স্থানীয় পর্যায়ে শাসন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা। স্থানীয় সমস্যা স্থানীয়ভাবে সমাধানের লক্ষ্যেই মূলত স্থানীয় সরকার কাজ করে।
বর্তমানে রাষ্ট্রের আয়তন বড় ও লোকসংখ্যা বেশি হওয়ায় কেন্দ্রে বসে সরকারের পক্ষে দেশের সকল অঞ্চলের সকল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ কমে স্থানীয় সমস্যার সমাধানও সহজ হয়। এটি বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বাংলাদেশে গ্রাম ও শহরাঞ্চল উভয় ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার কাঠামো বিকশিত হয়েছে। পাশের ছকে উভয় অঞ্চলের স্থানীয় সরকারের কাঠামো দেখানো হলো।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে তিন স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার কাঠামো চালু আছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন স্তর হলো ইউনিয়ন পরিষদ। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে আছে উপজেলা পরিষদ এবং জেলা পর্যায়ে আছে জেলা পরিষদ।
শহরাঞ্চলের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দুই ধরনের-পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশন। আটটি (০৮টি) বিভাগীয় শহর ছাড়াও কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে সিটি কর্পোরেশন রয়েছে এবং পৌরসভাগুলো অন্যান্য শহর এলাকায় স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব পালন করে।
স্থানীয় সরকারের গঠন
একমাত্র জেলা পরিষদ ছাড়া স্থানীয় সরকারের অন্য সকল কাঠামোর নেতৃত্বই নির্বাচিত হন জনগণের সরাসরি ভোটে। এগুলোর প্রতিটিরই কার্যকাল পাঁচ বছর।
ইউনিয়ন পরিষদ : স্থানীয় সরকারের প্রাথমিক স্তর হলো ইউনিয়ন পরিষদ। দেশে বর্তমানে ৪,৫৭১ টি ইউনিয়ন পরিষদ আছে। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একেকটি ইউনিয়ন গঠিত। ইউনিয়ন পরিষদ হলো গ্রামীণ এলাকার স্থানীয় সরকার। গ্রামীণ সমস্যা দূরীকরণ ও স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের বিকাশ ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি এর মূল লক্ষ্য। নির্বাচিত ১ জন চেয়ারম্যান, ৯টি ওয়ার্ড থেকে ৯ জন সদস্য ও সংরক্ষিত আসনে তিন জন মহিলা সদস্যসহ সর্বমোট ১৩ জন নিয়ে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত। (উৎস : স্থানীয় সরকার বিভাগ)
উপজেলা পরিষদ : কয়েকটি ইউনিয়ন নিয়ে একটি উপজেলা গঠিত হয়। একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান, একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং উপজেলার অন্তর্ভুক্ত সব ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং সকল মহিলা সদস্যের এক তৃতীয়াংশকে নিয়ে উপজেলা পরিষদ গঠিত হয়। দেশে বর্তমানে মোট উপজেলা পরিষদের সংখ্যা ৪৯২টি।
জেলা পরিষদ : কয়েকটি উপজেলা নিয়ে একটি জেলা গঠিত। দেশে ৬৪টি জেলা পরিষদের মধ্যে ৬১টি স্থানীয় সরকার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে। খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি এই তিনটি জেলা পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে। একজন চেয়ারম্যান এবং ২০ জন সদস্য নিয়ে জেলা পরিষদ গঠিত। ২০ জন সদস্যের মধ্যে পাঁচ জন হবেন মহিলা।
চেয়ারম্যানসহ সকলে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। জেলার অন্তর্গত সব মেয়র ও কাউন্সিলর, সব উপজেলার চেয়ারম্যান, সব পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর এবং সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ তাঁদের নির্বাচিত করেন। জেলার অন্তর্ভুক্ত সংসদ সদস্যগণ হবেন জেলা পরিষদের উপদেষ্টা।
পৌরসভা : শহর এলাকার স্থানীয় সরকার হিসাবে পৌরসভা গঠিত। বর্তমানে দেশে ৩২৭টি পৌরসভা আছে। একজন মেয়র, প্রতি ওয়ার্ড থেকে একজন করে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলরদের নিয়ে পৌরসভা গঠিত হয়। আয়তন ও জনসংখ্যার তারতম্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন পৌরসভার সদস্য সংখ্যা কম বা বেশি হতে পারে।
সিটি কর্পোরেশন : বাংলাদেশে ১২টি সিটি কর্পোরেশন আছে। ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর, গাজীপুর এবং ময়মনসিংহ। প্রতিটিতে আছে একটি করে সিটি কর্পোরেশন। সিটি কর্পোরেশনের প্রধানকে বলা হয় মেয়র। মেয়রের কাজে সাহায্যের জন্য আছে কাউন্সিলর। সিটি কর্পোরেশনের আয়তনের ভিত্তিতে কাউন্সিলরদের সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে।
কাজ : ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার গঠনের তুলনা একটি ছকের সাহায্যে দেখাও।
স্থানীয় সরকারের কাজ
স্থানীয় সরকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ব্যবস্থা। এটি তাত্ত্বিক অর্থেও সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণমুক্ত। জনহিতকর কাজ থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে স্থানীয় সরকার। স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়নের মূল দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে।
ইউনিয়ন পরিষদের কাজ
এলাকার উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদ অনেক দায়িত্ব পালন করে। যেমন :
• ইউনিয়নের সার্বিক উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন ;
• বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ;
• ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ;
• ইউনিয়নের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা ;
• প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা ;
• পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপকরণ সহজলভ্য করার ব্যবস্থা ;
• গরিব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান, বয়স্কদের শিক্ষাদান, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ইত্যাদির ব্যবস্থা;
• এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ;
• এলাকায় জমির খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা ;
• এলাকায় কোনো অপরাধ বা দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশকে জানানো এবং অপরাধের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টি;
• বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা যেমন : যৌন হয়রানি, যৌতুক প্রথা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক কাজ করা;
• এলাকায় শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য বিবাদ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা;
উপজেলা পরিষদের কাজ : উপজেলা পরিষদের কাজ অনেকাংশে ইউনিয়ন পরিষদের কাজের মতো। এছাড়া উপজেলা পরিষদ পাঁচশালাসহ বিভিন্ন মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করে। সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, তত্ত্বাবধান ও তার সমন্বয় সাধন করে। বিভিন্ন ইউনিয়নের মধ্যে সংযোগকারী রাস্তা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে।
জেলা পরিষদের কাজ
জেলার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনা করাই জেলা পরিষদের কাজ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: উপজেলা ও পৌরসভার সংরক্ষিত এলাকার বাইরে রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, আবাসিক হোস্টেল তৈরি, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, অনাথ আশ্রম নির্মাণ, গ্রন্থাগার তৈরি ও নৈশ বিদ্যালয় পরিচালনা, কৃষি খামার স্থাপন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ এবং পানি সেচের ব্যবস্থা করা । এছাড়াও জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণের কাজ এবং জেলার যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নেও কাজ করে ।
পৌরসভার কাজ
• বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা ;
• স্বাস্থ্যকর ও ভেজালমুক্ত খাদ্য বিক্রি নিশ্চিত করা ;
• শহরের পরিবেশ রক্ষার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা ;
• বিধি মোতাবেক ঘরবাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করা ;
• সড়ক নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা ; রাস্তার দুই পাশে গাছ লাগানো, পার্ক ও উদ্যান প্রতিষ্ঠা ও উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ সংরক্ষণ করা।
তাছাড়া পৌরসভা বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, এতিম ও দুঃস্থদের জন্য এতিমখানা পরিচালনা, লাইব্রেরি ও ক্লাব গঠন করা। ভিক্ষাবৃত্তি নিরোধ, খেলাধুলার ব্যবস্থা, মিলনায়তন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, জন্ম-মৃত্যু ও বিবাহ-নিবন্ধন, মহামারী ও সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্ৰণ ও বিশিষ্ট অতিথিদের অভ্যর্থনা প্রদানের ব্যবস্থা করাও পৌরসভার কাজ।
সিটি কর্পোরেশনের কাজ :
• বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা ;
• স্বাস্থ্যকর ও ভেজালমুক্ত খাদ্য বিক্রি নিশ্চিত করা ;
• শহরের পরিবেশ রক্ষার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা ;
• সুষ্ঠুভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করা ;
• সড়ক নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা ; রাস্তার দুই পাশে গাছ লাগানো, পার্ক ও উদ্যান প্রতিষ্ঠা ও উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ সংরক্ষণ করা ইত্যাদি ।
কাজ- ১ : তোমার নিজ ইউনিয়ন/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশনের কাজের বাস্তবায়ন পরিস্থিতি মূল্যায়ন করো। কোন কোন ক্ষেত্রে কাজ বাস্তবায়িত হচ্ছে না তা চিহ্নিত করো এবং প্রয়োজনীয় উন্নয়নের সুপারিশ করো। দলগতভাবে এ কাজটি করা যেতে পারে।
কাজ-২ : তোমার এলাকার স্থানীয় সরকারের কাজ বাস্তবায়নে তুমি কীভাবে সহযোগিতা করতে পারো?
Read more